You are here

নিরীহ পিস্তল হাতে দাড়ানো অসহায় দারোয়ান

এখন অনেক রাত। অনেক বলতে রাত দুইটা ত্রিশ মিনিট। ঘুমানো দরকার। ঘুমাতে যাবো এমন সময় চোখে বার বার নেমে আসে কুড়িগ্রামের চরমানুষের জীবন। ঠিক এই মুহূর্তে চরের অধিকাংশ মানুষ জেগে আছে। কারন তাদের গবাদি পশু চুরি হয়ে যেতে পারে। চরের মানুষ সন্ধ্যা সাতটার সময় ঘুমিয়ে যায়। তাদের প্রথম ঘুম ভাঙে রাত এগারো থেকে বারোটার মধ্যে। তারপর কেউ কেউ জেগে থাকে কেউ কেউ ঘুমায়। যারা জেগে থাকে তারা কেমন করে উজানে একটা ভিটেমাটি কেনা যায় তা নিয়ে গল্প বানায়, আর যারা ঘুমায়— জলের টানে ঘর ভেসে যাচ্ছে এমন ঘামদেয়া খোয়াব দেখে। চরের মানুষের কাছে উজান মানে ইউরোপ আমেরিকা— রংপুর বিভাগের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মানে বিদেশ।

আমরা যাচ্ছি মোহাম্মদ মেম্বরের চর। অলিপুর বাজার থেকে আধা ঘন্টা অটোতে অনন্তপুর, দেড় ঘন্টা ইঞ্জিন নৌকায়। তখন রাত প্রায় নয়টা। চরের সব মানুষ জেগে গ্যাছে— শহর থেকে দেবতার আগমন বলে কথা। ফোনের আমল— রান্নাবান্না হয়ে গ্যাছে। অলিপুর বাজারে আমাদের খাওয়া দাওয়া হয়ে গ্যাছে— তারপরও খেতে হবে— নতুবা সরল মানুষদের মনে কষ্ট লাগবে। খেতে বসি— ডাল, চিকেন, মহিষের দই। রাতের অন্ধকারে খোয়ারে চলে যাওয়া মুরগিডা জানে না সে সকালের আলো দেখবে না— আহারে!

খাবার শেষে দারুণ এক তৃপ্তি মনে বয়ে গেলো। দই আর ডালের শরীরে এমন নিষ্পাপ স্বাদ এক যুগে একবার পাওয়া যায় হয়তো। চরের মানুষ নিজেরা ডাল চাষ করে, নিজেদের মহিষ থেকে তারা দই উৎপাদন করে,নিজেরা সরিষা উৎপাদন করে, লাল চালের ভাত খায় তারা। অসাধারণ সুন্দর সহজ সরল জীবন।

শুনেছি কুড়িগ্রামে ৪৬০ চর রয়েছে— রয়েছে ষোলটি নদী— ব্রক্ষ্মপুত্র নদ, তিস্তা নদী,ধরলা নদী,দুধকুমর নদী,ফুলকুমার নদী, সোনাভরি নদী,হলহলিয়া নদী, নীলকমল নদী,গংগাধর নদী,শিয়ালদহ নদী, জিঞ্জিরাম নদী,বোয়ালমারি নদী, সংকোশ নদী, ধরণী নদী, কালজানী নদী, জালছিড়া নদী— জল ও স্থলের ভয়ঙ্কর সুন্দর অর্থনৈতিক জোন বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম তথা রংপুর বিভাগ। চরে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সহজ সুন্দর মন নিয়ে ফসলের চাষ করলে বাংলাদেশ যে একটি কৃষিপ্রধান দেশ তা পৃথিবীর কাছে প্রমান করতে দুই বছরই যথেষ্ট।

চরে চমৎকার পাটের চাষ দেখি— পাটগুলো আদি বাংলার শৈশবের মতো সুন্দর— চরে কেবল সরিষার চাষ করে বাংলাদেশের ভোজ্য তেলের সমগ্র সর্পগন্ধা চাহিদা মেটানো সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। শেষ রাতের নির্জনতার মতো নদীমাখা পলল পল্লব চরে কেবল গম চাষ করে ইউক্রেন রাশিয়াকে আমরা হালাল সালাম উপহার দিতে পারি—কিন্তু কেনো দিবো? কেনো আমাদের মহান কৃষি অফিসাররা আরামের ঘুম হারাম করে চরের মানুষদের কাছে যাবেন? কেনো? তারা বরং আমেরিকা মহোদয়, ইউরোপ মহোদয়ের কাছে কেমন করে নিজের চেহারাগাট্টি তুলে ধরা যায় সেই প্রত্যাশায় ইউটিউবে চোখ রাখবেন। আমিন।ছুম্মা আমিন।

রংপুর,কুড়িগ্রাম, নীলফামারিতে এখনো গরুর গাড়ি,ঘোড়ার গাড়ি দেখতে পাওয়া যায় এবং কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। খুবই দারুণ ব্যাপার। রাস্তাঘাট ভালো। ভালো মানে চলে। সিএনজি অটোরিকশা এ্যাবলএ্যাবল। তারপরও মানুষ গবাদিযান ব্যবহার করছে— আহারে বাংলার ভাওয়াইয়া গান— পরান শীতল করা গান।

সূর্য হেলে গ্যাছে— এমন সময় আমাদের নৌকার ইঞ্জিনে ঝামেলা দেখা দেয়— একটি চরে নামতে হলো— চরটির নাম সম্ভবত মেকুরের চর— এটি আমাদের গন্তব্যচর না— শিশুরা দৌড়ে আমাদের দেখতে আসে— বর্তমান পৃথিবী থেকে শত বছর পেছনে রয়েছে তারা। মনে কষ্টের একটা করুন সুর বাজতে থাকে— একই দেশ অথচ কতই আলাদা তাদের দৈনিক জীবন।

যমুনা সেতু হওয়ার আগে রংপুর বিভাগের মানুষের জীবনযাপন আরও আলাদা ছিলো। মানুষ নিজেদের এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইতো না— জনপ্রতিনিধিরা ঢাকা শহরে বসে বসে সহজ সরল সাধারণ মানুষদের আলু চাষ শেখাতো— তাদের সরলতাকে ভাবতো বোকামি। এখনো রংপুর বিভাগের মানুষ সহজ সরল— আপনাদের ভাষায় বোকা— খাদ্য বিজ্ঞানীদের ভাষায় তাদের মাথায় আয়োডিন কম—আমি বলি কী আপনারা যারা হোমো ভায়োলেন্স আছেন তারা জানেন না সরলতার নির্জলা আনন্দ কোথায় এবং কেমন।

রংপুর রেলওয়ে স্টেশনে নেমে তাকে ফোন দেয়ার ইচ্ছে হলো— তার কারনেই ছোট্টকালে প্রথম রংপুর নামটি শুনি— সে হারিয়ে গ্যাছে হিজল গাছের ছায়ায়— কোথায় আছে কেমন আছে কিচ্ছু জানি না। রংপুর আসার প্রথম ইচ্ছা পোষন করেছিলাম ২০০৭ সালে, আসলাম ২০২২ সালে— জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর সব রঙিন গাছের পাতায় লেখা থাকে না— পাতা ঝরে যায়— পাখিও আকাশ বদলায়— বদলে যায় সুর— বদলে যায় সুরের তাল লয় ছন্দ— নৃত্য করে কেবল নৃশংস সময়।

কুড়িগ্রামের চরে যারা বাস করে তাদের আদিনিবাস টাঙ্গাইল অথবা বলতে পারি বৃহত্তর ময়মনসিংহের অধিবাসী। চর দখল করার জন্যে যে সাহস ও প্রত্যক্ষ মানসিকতা দরকার তা কুড়িগ্রামের মানুষের নেই। রংপুর বিভাগের মানুষ দারিদ্র্য মহান টাইপের জীবনযাপন করে।

রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় চোখে পড়েছে কিন্তু মনে পড়েনি। তবে তাজহাট জমিদার বাড়িটি চোখে লেগে থাকার মতো— রাজবাড়িটি রংপুর শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রাজবাড়িটি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় নির্মাণ করেন— নির্মাণসময় লাগে প্রায় ১০ বছর। মহারাজা গোপাল রায় ছিলেন হিন্দু,পেশায় একজন স্বর্ণকার। প্রাসাদের ভেতরে সংরক্ষিত শেখ সাদির হাতের লেখা দেখে আবেগতাড়িত হয়ে উঠে মন। প্রাসাদের ফ্লোর থেকে রোফের উচ্চতা চোখে আটকে যাওয়ার মতো— অথচ বর্তমান সময়ে নির্মিত বিল্ডিংরুমের ফ্লোর টু রোফের উচ্চতা পারলে মাথা আটকে যায়। প্রাসাদের আঙিনায় বিচিত্র ফুলের ❀ বাগান— কত মৌমাছি অভিসারে আসে এখানে উড়ো আকাশের মতো খোলা মন নিয়ে— মধুপান করে ঘুমিয়ে যায় ফুলের মনোরম নির্জন বুকে।

জল ঝরছে— ফিনিফিনি। কুড়িগ্রাম রংপুর লালমনিরহাট নীলফামারীর স্থলভাগ জলে ডুবে যাওয়ার কথা— ডুবছে না— ডুবলেই আসবে অনুদান— বিদেশি ইউরো ডলার পাউন্ড আরবি মুদ্রা কয়েন— গরীব পাবে সিকিপয়সা— দালাল পাবে দালান বানানোর পর্যাপ্ত অর্থপর্ব এক দুই তিন। এমন বৃষ্টিকন্যা দিনে আমরা চলছি ডালিয়া ব্রিজের দিকে, তাও আবার অটোরিকশা করে— অলিপুর থেকে রংপুর,রংপুর থেকে লালমনিরহাট,লালমনিরহাট থেকে নীলফামারী। ডালিয়া ব্রিজ বা তিস্তা ব্রিজ সেই অর্থে বাংলাদেশের কোনো কাজে আসে না— তিস্তা ব্রিজ যেনো নিরীহ পিস্তল হাতে দাড়ানো অসহায় দারোয়ান ফারাক্কা ডাকাতের সামনে। বাংলাদেশ অসহায়, অসহায় বাংলাদেশের মানুষ, অসহায় বাংলাদেশের আকাশ বাতাস নদী নালা।

চলতে চলতে দেখি রংপুর বিভাগের ঘরবাড়ি— তাদের বাড়িঘর টিনের, পাকা ঘর খুব কম চোখে পরেছে, সুচারু বিল্ডিং নাই বললেই চলে, তবে জুতা ছাড়া রাস্তায় হাটাহাটি করা লোকের সংখ্যা খুবই কম— মিলফ্যাক্টরি জীবনের তেমন দেখা মিলেনি— দেখা মিলে কৃষিভিত্তিক সমাজ আর শ্রমিকধারা জীবন— যমুনা সেতু হওয়ার পর ঢাকা চট্রগ্রাম কুমিল্লায় প্রচুর লোক ভাগ্য ফেরাতে চলে আসে— অনেকে বাস্তবভাগ্য ফেরাতে সক্ষমও হয়— যারা ভাগ্য বদল করে তারা আর গরীব অসহায় মাটির কাছে ফিরে যায় না— চোখের বিছানায় ঘুমের চাষ করে তারা শান্তিতে আলোবল খেলে।

খেলে যাও মহানগর খেলে যাও— গ্রাম জানে মহাকাব্য, গ্রাম জানে মহাকালের মালিশ— নালিশ করে লাভ নেই— উকিল ওজু করে মিথ্যা কথা বলে— ওজু করে মিথ্যা বললে নাকি মিথ্যা হয় না— হা হা হা— হেসে হেসে সময় উজানে ভেসে যাবে— কিচ্ছু করার থাকবে না!

সাহেবের আলগা চর, দই খাওয়া চরে বাচ্চাদের মতো সাজুগুজু করা স্কুলকে দেখে মনে হয়েছে ডিমের খোসা— ডিম খেয়ে চলে গ্যাছে অন্যকোনো মানুষ অন্যকোনো আইডিয়া— দই খাওয়া চরের আরেক নাম কালোর চর— কালো নিশ্চিত চরের প্রভাবশালী কেউ— প্রভাবশালীদের একটি কমন রোগের নাম আধিপত্য বিস্তার— দারিদ্র্য মানসিকতা হয় শোষণ করে নতুবা শোষণ মেনে নিয়ে থাকে— সেই মানসিকতা কমিনিউকেশন জানে না। সাহেবের আলগা চরে মিমের চোখে আমি পড়াশোনা দেখেছি, দেখেছি বিশ্বজয়ী প্রেষণা— আহারে সুযোগের অভাব,আহারে অনটন!

অলিপুর বাজারের মিষ্টি দারুণ— সেখানে খেজুরের গুড়ের মিষ্টি খেতে পেয়ে নিজের প্রয়োজনকে একটু হলেও শান্তি দিতে পেরেছি— শুনেছি কুড়িগ্রামের নদী পথে ভারতের মালবাহী জলবাহন আসা যাওয়া করে— দই খাওয়া চরের পাশেই ভারতের আসাম— তাদের পতাকার নিচে লাল কালো অস্ত্র নিয়মিত খেলা করে যেখানে ফেলানি মাত্র লাশময় আবর্জনা। আবর্জনা জিন্দাবাদ— সবার জিন্দেগী যেনো পাতার আড়ালে সূর্যলুকানো সুখ।

Leave a Reply

Top