
ভুলের জঠরে
বায়তুল্লাহ্ কাদেরী
বলিঘোড়া খুব কাছে এসে হ্রেষা ডাকে:
উঠুন, সম্ভ্রান্ত। উঠুন এ পৃষ্ঠদেশে।
ভাবলাম, এই আরোহণ যদি হয় নদী-মদিরার দেশে
আর না ফেরার ? যদি হয় ভুলে-যাওয়া ঋণের চারণভূমি
তাহলে কি ঘোড়া স্থির হবে ঘূর্ণন রেখায় ?
আবহমানের কোল ঘেঁষে আমিও দাঁড়াই
ছিলাম, রয়েছি, রবো- এইভাবে মর্ত্যময় একজন ভাবে,
অন্যজন খুব ভোরবেলা অপরজনের কাছে এসে বলে
পৃথিবীতে যে লোকের জন্য দম বন্ধ হতে যাচ্ছিল রুহের ফেরেশতার
তারও প্রশ্ন ছিল: ছিলাম, রয়েছি, রবো- এসবের মানে কি বলুন?
জনাব, জবাব দিয়েই তবে নিয়ে নিন আমার রুহের তোহফা।
ফেরেশতাটি থ’ মেরে তাজ্জব! বলে কি এ গোয়ালার পুত !
ঝিয়ের পেটেই কি না মায়ের জন্ম! তাহলে ঝিটা
কার? কোথায় সে ছিল, রয়েছে কোথায়, কিংবা রবে
কোন ভুলের জঠরে ?
কবিতাটি এক অস্তিত্ববাদী ভ্রমণ। বলিঘোড়া এখানে নিয়তির রূপক, যেটি মানুষকে টেনে নেয় অজানা গন্তব্যে। “ছিলাম, রয়েছি, রবো”—এই পুনরাবৃত্তি প্রশ্ন তোলে আত্মপরিচয়ের, সময়ের এবং জন্মের বোধ নিয়ে।
কবিতায় রুহ ও ফেরেশতার প্রসঙ্গ ইসলামী ভাবনায় মৃত্যু-পরবর্তী জিজ্ঞাসাকে জাগিয়ে তোলে, যেখানে উত্তর নেই, শুধু বিস্ময়। শেষদিকে “গোয়ালার পুত” বা “ঝিটা কার?” জাতীয় ভাষা ব্যবহারে কবি প্রচল সমাজের শ্রেণিবিভক্তি ও জন্মপরিচয়ের অন্ধতা নিয়ে রূঢ় কটাক্ষ করেছেন।
এটি এক ভাষাদায়ক বেদনাবোধকে স্পর্শ করে এবং স্পষ্ট করে অথচ গভীর দর্শনকেলি কবিতা এটি—যেখানে মানুষ নিজের উৎস আর ভবিষ্যৎ দুটোকেই “ভুলের জঠর” বলে মনে করে।
একটি জটিল, গভীর দর্শনচিন্তায় আচ্ছাদিত কবিতা এটি—যা বাংলা কবিতার গতানুগতিক রোমান্টিকতা বা আবেগ-নির্ভর ধারা থেকে অনেক দূরে। বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর এই কবিতা সময়, মৃত্যু ও আত্মপরিচয়ের প্রশ্নকে তীব্র অস্তিত্ববাদী ব্যঞ্জনায় তোলে— “ভুলের জঠরে” কবিতাটি পড়ে মনে হয়, কবি বুঝাতে চেয়েছেন—আমরা এমন এক বাস্তবতায় বাস করি যেখানে আমাদের ‘ভুলে’ রাখা হয়েছে। এই ভুল শুধুই বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, বরং জুলুমের একটি কৌশল। একজন অস্থির মানুষ শিকড় খোঁজে না, সে স্থির হতে চায়। আর শাসকগোষ্ঠী ঠিক এটাই চায়—আপনি যেন স্থির হতেই ব্যস্ত থাকেন, উৎস না খোঁজেন। কবিতায় ফেরেশতা ও রুহের কথাও যেন সেই অস্থিরতাকে চিহ্নিত করে—শুধু অস্তিত্ব নয়, প্রশ্নও হারিয়ে ফেলা হয়েছে।
কবিতাটি মুক্তছন্দে লেখা, যা একে মুক্ত ভাবপ্রবাহে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। ভাষায় সুর রয়েছে, কিন্তু তা নিয়ন্ত্রিত নয়—এটাই তার শক্তি। চিত্রকল্প জটিল, বহুবোধ্য। “থ’ মেরে তাজ্জব”, “গোয়ালার পুত”, “ঝিয়ের পেটেই কি না মায়ের জন্ম”—এইসব পঙ্ক্তি কাব্যিক অভিঘাতকে রূপান্তরিত করে।
ভুলের জঠরে” কবিতাটি মূলত এক ধরনের নিরাসক্তি ও নিঃশব্দ আত্মপরিচয়হীনতার কবিতা। এখানে নেই আবেগের বিস্ফোরণ, নেই ভালোবাসা বা ঘৃণার প্রকাশ—আছে শুধু এক অন্তর্গত উদাসীনতা, যা Anagapesis-এর চূড়ান্ত রূপ। কবির “ছিলাম, রয়েছি, রবো” পঙ্ক্তিটি যেন এক আত্মার নিঃসাড় পুনরাবৃত্তি—যেখানে অস্তিত্বের স্বীকৃতিও ক্লান্ত।
ফেরেশতার মুখে বিস্ময়, মানুষের মুখে প্রশ্ন, আর গোয়ালার পুত—সব মিলে গড়ে ওঠে এমন এক জগৎ, যেখানে সম্পর্ক, শোক, শ্রেণি বা জন্ম—সবকিছুই অনুভূতিহীন ব্যঞ্জনায় রূপান্তরিত। কবিতাটি বলে না “ভালোবাসা হারিয়েছে”, বরং বলে, “তা হারিয়ে যাওয়ার পরও যা থাকে না—সেই শুন্যতাই চূড়ান্ত— বলিঘোড়া”: এটি ভাগ্য, প্রলোভন বা মৃত্যুর দূত রূপে এসেছে, যেখানে আরোহনের ডাক রয়েছে— “নদী-মদিরার দেশ”: বিস্মৃতি বা চিরতরে হারিয়ে যাওয়া কোন জগৎ।
বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর কবিতার একটি মজার দিক হলো সূচনালাইন যা বোধের রচনা অর্থাৎ একধরনের ভাব ও ভাষার আরোহন এবং অবরোহন প্রক্রিয়ায় যুক্তযুদ্ধ কিংবা মিলন কাতরতা— “বলিঘোড়া খুব কাছে এসে হ্রেষা ডাকে: উঠুন, সম্ভ্রান্ত। উঠুন এ পৃষ্ঠদেশে।” বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর কবিতার শেষে থাকে দার্শনিক সংশয় আলাপ তবে আলাদা আলাপ যা ভাবকে ভাষা থেকে আলগা করে— এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি—
”কোথায় সে ছিল, রয়েছে কোথায়, কিংবা রবে কোন ভুলের জঠরে?”