
মানুষের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার মানুষ। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য প্রায় এক। কিন্তু মানুষের সৌন্দর্য বৈচিত্র্যমিত্র।
মানুষের হিংসা ভালো লাগে, মানুষের রাগ ভালো লাগে, মানুষের অভিমান ভালো লাগে, মানুষের নির্লিপ্ততা ভালো লাগে। আকাশ যেকারনে আকাশ সেই কারনে আকাশকে ভালো লাগে। মানুষ যে কারনে মানুষ সেই কারন ছাড়াও মানুষকে ভালো লাগে।
সৌরজগৎ কসমিক সময়ের কাছে একটি বালির চেয়েও ছোট। আর পৃথিবীর জায়গা তো সেখানে নেই বললেই চলে। মানুষ ত আরও নেই। তবুও মানুষ একটা পারমানবিক বোমার নাম, মানুষ একটা ঐতিহাসিক প্রেমের নাম।
কোপাই নদীর সাথে কুমিল্লার গোমতী নদীর বেশ মিল। গোমতী নদী কিন্তু আমাদের ছোট নদী না যে বাঁকে বাঁকে চলে।
সন্ধ্যা মাঝি সাঁওতাল বালিকা। দশম শ্রেনির ছাত্রী। তাকে দেখে আমার মাথিনের কথা মনে পড়ে। ধীরাজ বেটা কৃষ্ণের যোগ্য বংশধর হয়তো। এখানে মাথিনকূপ নেই, আছে কংকালীতলা। সন্ধ্যা মাঝি কংকালীতলা মাঠের রাখাল। মা তার আজ অসুস্থ, তাই সে স্কুলে যায়নি। চমৎকার সরল মন আর লাজুক হাসি দিয়ে সন্ধ্যা মাঝিকে ভগবান সজ্জিত করেছেন— কোপাই নদীর মতো বাঁকে বাঁকে চলে।
কংকালীতলা থেকে লাভপুর। ফুল্লুধারার মতো সবুজ ধানক্ষেত। ধানক্ষেতে বাতাস নাচতে থাকে নাবোঢ়া কন্যার হাসির লাহান। রোদ এসে বাতাসের লগে কামলার ভূমিকায় কিছু কথা বলে যায়। ইনিয়ে বিনিয়ে বলা কথা মানুষের কানে যায় না। মানুষ মিষ্টির মতো কড়া মিষ্টি চায়, মেশানো মিষ্টি আর ভালো লাগে না তাদের। বাবু বাগদী তবুও বাউল গান করে, মানুষের কাছে মানুষ হয়ে পৌঁছে যেতে চায়। কিন্তু মানুষ ত মানুষের ভেতর শুধু মানুষ চায় না, পশুও চায়।
বীরভূম জেলার বোলপুর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে কোপাই নদীর তীরে শক্তিপীঠ কঙ্কালীতলা। তন্ত্রচূড়ামতির মতে, এটি ২৮ নং সতীপীঠ। দূর অতীতে এই জায়গাটি কাঞ্চি নামে প্রসিদ্ধ ছিল। পীঠ নির্ণয়তন্ত্র অনুসারে এখানে সতীর অস্থি পরেছিল, সেই কারণে এই পীঠের নাম হয় কঙ্কালীতলা। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে লেখা রয়েছে, এখানে সতীর কটিদেশ বা কোমরের অংশটি পরেছিল। তবে এই কথা বলতেই হবে এই শক্তিপীঠ নিয়ে শাস্ত্র ও মানুষদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে।
এই শক্তিপীঠের দেবী গর্ভাদেবী নামে প্রসিদ্ধ ও ভৈরব রুরু নামে পূজিত হয়। দেবীর মন্দির সংলগ্ন একটি কুণ্ড রয়েছে যা নাকি এটির সঙ্গে বহু মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে। কুণ্ডের মধ্যে কয়েকটি প্রস্থর খণ্ড আছে, যেগুলিকে সাধকরা দেবীর দেহের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রস্থর খণ্ডগুলি কুড়ি বছর অন্তর কুণ্ড থেকে তোলা হয়, পরে পূজার পর সেগুলিকে পুনরায় কুন্ডের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। লোককথানুসারে কঙ্কালীতলার কুন্ডের সঙ্গে কাশীর মনিকরনিকা ঘাটের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। অলৌকিক ঘটনা কঙ্কালীতলার পোশাক। কঙ্কালীতলা গুপ্ত তন্ত্রসাধনার জন্য খুবই বিখ্যাত।
সন্ধ্যা মাঝিকে আমার কেবল ছিপছিপে রাখাল মনে হয়নি। মনে হয়েছে আমার জন্যে সে আজগে কোপাইকন্যা হয়ে এসেছে। তাকে দেখে এমন ভালো লাগার কারন জানি না আমি। আমি জানি জীবন বয়ে চলে। প্রবাহিত জীবনে ঢেউয়ের পর ঢেউ। সন্ধ্যা মাঝি এক ঢেউয়ের নাম। আমি তার ঢেউয়ের ফল। এই সমাজ এই সভ্যতা এই নিয়মনীতিকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে হলো। মনে হলো, আমার আর সন্ধ্যা মাঝির মাঝখানে পৃথিবীর মানুষের বানানো নিয়ম নৃত্য করে চলছে। কিচ্ছু বলতে পারেনি তাকে। সমাজ পই পই করে আমার ভেতরে জেগে উঠে। তার সাথে আর দেখা হবে না আমার। রাখালি আমার জীবনে থেকে যাবে স্মৃতিকায়াময়। কঙ্কালীতলা থেকে যাবে। জীবনে সেখানে হয়তো যাওয়া হবে আমার আরও কয়েকবার। কিন্তু রাখালি সন্ধ্যা মাঝি!? সে রাতের ছায়ার মতো মিশে যাবে সময়ের আলোচক্রের ভেতর থেকে ভেতরে। সন্ধ্যা মাঝি আধুনিক কোনো মেয়ে নয়, প্রসাধনীর বাহনায় ঢাকা পড়েনি তার নিষাদ দেহতরুর শাখাপ্রশাখা। তবু সে আমার প্রিয়তম শহর প্রাগৈতিহাসিক মায়া কঙ্কালীতলার অলৌকিক সুর।
একান্ন সতীপীঠের অন্যতম হল ফুল্লরা। লাভপুরের প্রতিবেশী ফুল্লরা। বোলপুর থেকে নানুর– কীর্ণাহার হয়ে বাসে লাভপুরে নেমে ফুল্লরায় যাওয়া যায়। আবার বোলপুর থেকে রেলপথে এগিয়ে প্রান্তিক-কোপাই পার হয়ে আমোদপুর স্টেশনে নেমে আমোদপুর-কাটোয়া ছোট লাইনের ট্রেনে চড়ে লাভপুরে নেমেও ফুল্লরা যাওয়া যায়। হাওড়া থেকে সরাসরি ট্রেনেই পৌঁছে যাওয়া যায় আমোদপুর। লাভপুর স্টেশন যেন শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি। লাল টুকটুকে ছোট্ট স্টেশন।মেয়েদের লিপস্টিকের মতো কৃষ্যমান। স্টেশন থেকে সওয়া ১ কিমি উত্তর-পূর্বে ফুল্লরা পীঠ। দেবীর অপর নাম অট্টহাস। এই পীঠ জনবসতি থেকে দূরে এক ছোট্ট টিলার উপর অবস্থিত। লাল কাঁকুরে মাটির টিলা। নীচে প্রবাহিত উত্তর অভিমুখী কোপাই নদী। পাশেই মহাশ্মশান। পীঠের প্রবেশতোরণ চোখশীতল্কায়াময়। গাছপালা পরিবেষ্টিত পীঠের পরিবেশ ছায়াময় এবং বেশ সাজানো গোছানো। নীরব নিস্তব্ধতার জাদুঘর। বলা হয়ে থাকে এখানে সতীর নীচের ঠোঁট পড়েছিল। দেবী এখানে ফুল্লরা, আর ভৈরবের নাম বিশ্বেশ। বিশ্বেশ পীঠ চত্বরেই আলাদা একটি ছোট মন্দিরে অবস্থান করছেন। মূল মন্দিরে কোনও বিগ্রহ নেই। আছে একটি কচ্ছপাকৃতি শিলাখণ্ড— জবা, বেলপাতা, রক্তবস্ত্র আর সিঁদুরে চর্চিত। ভালো করে দেখলে মনে হয়, পাথরের সামনের ভাগটা ঠোঁটের মতো। মন্দিরের সামনে দু’টো শিবমন্দির, মাঝ দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে বিরাট এক দিঘিতে। নাম দেবীদহ বা দলদলি। প্রবাদ আছে, দিঘির জল কোনও দিন শুকোয় না। চায়না গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে একধরনের গরম শরীরে ছায়ার মতো লেপ্টে আছে। দীঘির জলে নিজেকে ভিজিয়ে নিলাম। ভালো লাগলো। বেশ ভালো লাগলো। ইতিহাসের কোথায় যেন একটা টান পড়ে গেলো। শীতল হয়ে গেলো আমার চিত্ত উদাস মন। মন্দিরের দেয়ালে ঠাই পাওয়া মূর্তিকারুকার্য দেখে মনে হলো যৌন সাধনার যৌথ প্রয়াস আমাদের ভারতবর্ষের সনাতন মাটি ধারন করে।
রাস্তার কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশ আর বীরভূমের রাস্তাকাজ প্রায় একই পদ্ধতির অনুসরণনীতি মেইনটেইন করে বলে আমার মনে হলো। ধুলাবালি আর ধুলাবালি। ইবনে সীনা বা আবে সিনার কথা মনে হলো। মনে হলো এক হাজার বছর বেচে থাকার একটি ছোট্ট দ্বীপউপায় লোকটি আমাদের দেখালেন।