You are here

বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের স্মৃতি

কাসেম ভাই। পারভেজ মুন্না নামে নিজের পরিচয় দিতে ব্যাপক স্বাচ্ছন্দবোধ করেন তিনি। কাজ করেছেন ১৮ বছর বাংলাদেশ নৌবাহিনিতে। কবিতাবাহিনিতে ইদানিং ব্যাপক তোড়জোড়রে নিজেকে যুক্ত করেছেন। ভালোবাসেন কবিতা ও বই পড়তে। ইদানিং তেমন বই পড়ছেন না, ইদানিং কবিতাঘোর তাকে আক্রান্ত করেছে।

একদিন রাতে তার মাথায় কবিতা নাযিল হচ্ছে, এমন সময় তার প্রস্রাব পায়। কবিতাঘোর চলে যাবে, তাই লুঙ্গি না পরেই টয়লেটে যাত্রা করেন তিনি। তার কাছ থেকে জানতে পারি— হয় তিনি একটা কবিতা জীবনে লেখবেন নতুবা পাগল হয়ে যাবেন।

কমান্ডো প্রশিক্ষন তিনি নিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনি থেকে। এই প্রথম কোনো সামরিক বাহিনির লোকের সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে যিনি কবিতা লেখার জন্যে জীবনের দীর্ঘ সমুদ্র সফেন অতিক্রম করার প্রয়াস করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হেমন্তী গল্প পড়ে সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ জন্মে ১৯৯৮ সালে। তারপর থেকে জ্ঞানতৃষ্ণা কাতর পারভেজ মুন্না ভাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিজের মনকে নিয়ে ছুটাছুটি করেছেন জ্ঞানফলের রস আহরনের উদ্দেশ্যে।

ইয়াছিন খান। পেশায় একজন রিক্সাচালক। তার বাড়িও মুন্না ভাইয়ের মতো সরাইল। যদিও শিল্পীর কোনো দেশ কাল নেই। ইয়াসিন খান হাজারের অধিক গান রচনা করেছেন। ইয়াসিন খান অনেকের কাছে চেয়ারম্যান নামে পরিচিত। তার স্বপ্ন তিনি একদিন এলাকার চেয়ারম্যান হবেন। তার পোশাকরুচি যথেষ্ট পরিমার্জিত গোছানো। তার গান বাউল টাইপের। তিনি বাউল জীবনযাপন করেন কিনা জানি না, বাউল গান তিনি রচনা করেন পাখিমন স্বভাবে।

মুন্না ভাইয়ের বাসায় দুপুরের খাবার শেষে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম উল্লাসকর দত্তের জন্মস্থান সরাইলের কালীকচ্ছের দিকে। আমরা বলতে পারভেজ মুন্না, ইয়াসিন খান, কাজী বর্ণাঢ্য আর আমি এমরানুর রেজা। উল্লাসকর দত্তের বাড়ি যাওয়ার পথে দেখলাম সরাইল সরকারি কলেজ। সরাইলে বিখ্যাত কুত্তা আছে জানতাম, জানতাম না সরাইলে সরকারি কলেজও রয়েছে। সরাইল সরকারি কলেজের মাঠে দেখতে পেলাম মানুষের হমান ঘাস নির্জন নিরবতা গল্প করছে প্রাকৃতিক আনন্দে।

উল্লাসকর দত্তের বাড়িটি দারুন নিদারুন অবহেলায় নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে আজও স্বর্নকারের হাতের মতো— বুকের কোথায় যেনো একটা টান পড়ে। উল্লাসকর দত্ত একজন জীবনব্যাপী বিপ্লবের পথের মানুষ। বিলাতি শিক্ষা তাকে বিপ্লবের পথে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা নির্মান করতে পারেনি। দেশ ও মানুষের জন্যে নিজের জীবনে উল্লাসকর সহ্য করেছেন অমানবিক অত্যাচার— ব্রিটিশ বিদ্যমান শক্তির অত্যাচারে তিনি একসময় মানসিকভাবে ব্যাপক আঘাতগ্রস্ত হন। দেশভাগের পর তিনি চলে আসেন আবারো নিজ জন্মস্থান কালীকচ্ছ। ইতিহাস বলে কালীকচ্ছে বছর দশক থেকে পুনরায় কোলকাতায় ফিরেন ১৯৫৭ সালে— বিখ্যাত বিপ্লবী বিপিন চন্দ্র পালের মেয়েকে বিয়ে করেন— পরে আসামের শিলচরে চলে যান। জীবনের শেষ দিনগুলো শিলচরে কাটিয়ে ১৯৬৫ সালের ১৭ মে পরপারে পাড়ি দেন।

অনুশীলন সমিতি কিংবা যুগান্তর দলের সক্রিয় বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের শারীরিক উপস্থিতি আমাদের চোখে আজ ভাসে না কিন্তু তার মানসিক উপস্থিতি আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ‘আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলা’র কথা আমরা ভুলতে পারি না, ভুলতে পারি না ১৯০৮ সালের ২ মে উল্লাসকর দত্ত ইংরেজ মাথার শোষিত হাতে ধরা পড়েন— ১৯০৯ সালে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার রায় দেয় আদালত— রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আদালত ফাঁসির রায়ের পরিবর্তে যাবজ্জীবন দেয়। তবে কারাবাসে উল্লাসকর দত্তকে যে পরিমাণ অত্যাচার ভোগ করতে হয়েছে তাতে সবসময় মনে হয় ফাঁসির রায়ই শ্রেয়তর ছিল।

আমাদের চোখ পড়ে অস্ত্রজমারাখা ছোট্ট খোয়ারটির দিকে। আজও বাতাসে লাশের গন্ধ পাই। আজও মনে হয় বিপ্লব বিপ্লব বলে পৃথিবীর পথে যাত্রা করি মানুষের পতাকা হাতে নিয়ে। আমাদের দৃষ্টি পরে উল্লাসকর দত্তের অস্ত্রজমারাখা বারুদের দিকে। বাড়িটিতে অলৌকিক এক নিরবতা বিরাজ করে আজও। অনেক পুরাতন বাড়ি দেখেছি কিন্তু এই বাড়িটির পুরাতন রঙ মনের মতো নিরাকার তবে আকারে সাকার। বাড়িটির রঙে একপর্যায়ের পৌরানিক ছায়া খেলা করে। আজ বাড়িটা একা, একদিন অনেক কিছু ছিলো তার সাথে।

তারপর আমরা চললাম কুফাইরা খালের ব্রিজের দিকে। কুন্ডা বিরিবাদ থেকে গোকর্ন যাওয়ার পথে পরে এই কুফাইরা ব্রিজ। এই খাল নাকি অতীতে অনেক প্রান কেড়ে নিছে— তাই তার নাম কুফাইরা ব্রিজ। কুফা ব্রিজে কিছুক্ষন অবস্থান করি— আহা প্রশান্তির বাতাস!

পারভেজ ভাই জানায় সূর্যডুবে যাওয়া পরক্ষনের বাতাসই নাকি লিলুয়া বাতাস। আমি জানি লিলুয়া বাতাস মানে উদাসী বাতাস। যে বাতাস মনকে উদাস করে তুলে তাই লিলুয়া বাতাস। ষোলো বছরের যুবতী কন্যা প্রথম প্রেমে পড়ে হরিনীর মতো আলতো চোখে যেমন করে দৃষ্টি রাখে আবার সরানো চোখে গল্প রচনা করে তেমনি লিলুয়া বাতাস তার দেহতরী প্রকৃতির উদার আয়তনে মেলে ধরে।

অন্ধকার আর জলের নিজস্ব রঙের সারি আর বাতাসের উদাসি আহবান কুফা বা কুফাইরা ব্রিজকে রহমতের দরজা করে তুলেছে। জীবন এইখানেই অবিরাম অবিরত সুন্দর মনোরম প্রশান্তিময়।

এখন ইয়াসিন খানের রিক্সা চলছে সরাইল আশুগঞ্জ আসনের সাবেক এমপি এডভোকেট জিয়াউল হক মৃধার বাড়ির দিকে। আমার তার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। বাড়িতে আসবাবপত্রের আধিক্য নেই। এইখানে সেইখানে বইপত্র ছড়ানো ছিটানো। দুইবারের নির্বাচিত এমপি এডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা নতুন বাড়ি করেছেন কিন্তু বাপদাদার ভিটাবাড়ি স্মৃতি হিসাবে রেখে দিয়েছেন— বিষয়টি আমার কাছে ব্যাপক ভালো লাগে।

তিনি আমাদের পেয়ে আনন্দিত হলেন— আন্তরিকতার সাথে উপহার দিলেন এক কবিতাময় সমৃদ্ধ সন্ধ্যা। আড্ডা, গান, কবিতা ও রাজনৈতিক বাস্তববার্তায় তিনি আমাদের মগজে পুঁতে দিয়েছেন স্বপ্নের বীজ— দূর করেছেন অনেক অতীত আলেয়া— খুলে দিয়েছেন চেতনার কপাট। আমরা কান পেতে শুনি কবি জিয়াউল হক মৃধার কণ্ঠে রাশিয়ায় বসে লিখা তাঁর একটি কবিতার অংশবিশেষ। আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম দেশের গুনগত মানগত পরিবর্তনের জন্যে কি করা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন বিপ্লব আন্দোলনের কথা। আমি বললাম বিপ্লব আন্দোলনে আপনারাইতো বড় বাধা। তিনি বললেন, ‘আমাদের মেরে ফেলো।’

এডভোকেট জিয়াউল হক মৃধার কথা শুনে আমার অনেক মৃত সেল জেগে উঠে। জাগ্রত মনে আমি আর কাজী বর্ণাঢ্য ভাই আশুগঞ্জের পথে যাত্রা করি। আমাদের বাহনের নাম সিএনজি। ভাড়া ৫০ প্লাস ৫০ একশত টাকা মাত্র। বিশ্বরোড এসে বিদায় নিয়েছেন ইয়াসিন খান। তিনি যে রিক্সওয়ালা, দিন তার এমন যাবে!?

Leave a Reply

Top