You are here

স্বরসতী

আকাশ।
আজ কত দূরে।

অথচ একদিন এই আকাশ হাতের কাছে ছিল। তখন আজকের মতো এতো মানুষ ছিলনা। মানুষ বলতে কেবল আমাদের পরিবার। ঠাকুরমা ছিলেন আমাদের পরিবারের সবচেয়ে লম্বা মানুষ। ঠাকুরমার রাগও ছিল খুবই বেশি। তাঁর একটি সুন্দর বদভ্যাস ছিল। আর তা হল খুব সকালে ঘুম থেকে উঠা, আমাদেরকে উঠানো। একদিন সকালে তিনি উঠোন ঝাড়ু দেয়ার কাজে ব্যস্ত। ঐ দিন আকাশটা কেন যেন আরো একটু নিচে নেমে আসে। ঠাকুরমা যখন সোজা হয়ে দাঁড়ায় তখনই আকাশের সাথে ধাক্কা খায়। ঠাকুরমা খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন। ইয়া আলী বলে আকাশকে দিলেন এক ঝাড়ুমধ্যম।

আকাশ আবার যথেষ্ট ব্যক্তিত্ববান। খুব লজ্জা পেল। আকাশ সিদ্ধান্ত নিল আর না, আর পৃথিবীর মানুষের কাছাকাছি থাকা যাবেনা। পৃথিবীর মানুষ হাতের কাছের মূল্যবান কিছু মূল্যায়ন করতে জানেনা। দূরের তুচ্ছ কিছু নিয়ে রাতকে দিন বানাতে পারে।

যেই কথা সেই কাজ। আকাশ দূরে চলে যায়। একেবারে চোখের সীমানা ছাড়িয়ে।

আকাশের খোঁজে পাখি উড়ে।

পাখি হয়তো আকাশ খোঁজে। পাখির আকাশে মেঘ উড়ে। মেঘেরাও আকাশ খোঁজে পায়না। আকাশকে ছোঁয়ার কত শখ আমার। কেবল আকাশকে স্পর্শ করার জন্য পাখি হতে চাই, মনে মনে গান ধরি—

এমন যদি হতো
আমি পাখির মতো
উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ

হায় ভগবান! একদিন সকালে পাখি হয়ে উড়তে থাকি। বাতাসে উড়া আর জলে সাঁতার কাটার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবে জল নিচের দিকে টানে না, বাতাসে ভাসমান থাকা যায়না। পৃথিবীর মানুষের শরীরে চুম্বক আছে, তার দিকে টানতে থাকে কেবল।

আমার সাথে আরেকটি পাখি উড়ে। মেয়ে পাখি। তার নাম স্বরসতী। তার কোমড়ের বাঁক যেন কামনার নদী। অধর যেন গভীর গাঙ আর আমি যেন গাংচিল। দুজন দুজনের খুব কাছাকাছি। তার মনের দেখা পাই আমার মনের আয়নায়। আমার শরীর আর তার শরীর বহুদিন জিরো ডিগ্রিতে অবস্থান করে। বহুদিন মিশন পজিশনে তার সাথে আমি। তার শরীরের অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া আমার শরীরে আস্তানা গাড়ে। তার দেহপালিত জীবাণু আমার শরীরের এসে পরিণত ভাইরাস, বিদেশী ভাইরাস। বিদেশী ভাইরাস আমার রোগ প্রতিরোধ সেলে আক্রমণ করে। হ্রাস পাই প্রতিরোধ ক্ষমতা। পাখি অবস্থাতেই আমার মৃত্যু হয়।

আমার আর আকাশ ছোঁয়া হলনা!

অনেক শতাব্দীর পর…

পৃথিবীতে আমার বন্ধুর সংখ্যা অনেক কম। অনেক কম বন্ধুর মাঝে সুপ্রিয় একজন। বাড়ি শ্রীরামপুর, হুগলী। তার বাড়িতে আমার নেমন্তন্ন। নিদিষ্ট সময়ে তার বাড়িতে পৌঁছানোর কথা থাকলেও পৌঁছাতে পারি নাই। তার বাড়িতে যখন উপস্থিত হয় তখন সন্ধ্যা ছয়টা। হুগলীর সন্ধ্যা অনেকটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা, অনেকটা বিধবা নারীর মানসিক অবয়বের মতো। বন্ধুটির বাড়িতে উৎসবের কোলাহল। পুজার উৎসব। সুপ্রিয়ের বাড়িতেই পুজামণ্ডপ।

আজ নাকি স্বরসতী পুজা!

স্বরসতী নামটা শুনতেই আমার বুকের ভেতরে একটি বজ্রপাতের শব্দ শুনি!

এ কোন স্বরসতী?

আমি যখন রেগে যাই কিংবা অবাক হয়ে যাই তখন কোনো কথা বলিনা, বলতে পারিনা।

স্বরসতী? নামটি আমাকে অবাক করেছে। ধীরে ধীরে পুজামণ্ডপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সাধুদৃষ্টির মদনতাড়নায় স্বরসতীর দিকে তাকালাম। আমার শরীরের রক্ত যেন টগবগিয়ে দৌঁড়াবে এমন, কথা বুঝি থেমে গেল। স্বরসতীর ভরা যৌবন আমাকে আদিম অন্ধকারে দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সে এতক্ষণ এক নজরে তাকিয়ে ছিল আমারই খোঁজে হয়তো। তাকে পরিপূর্ণ চিনতে আমার আধটুকু সমস্যা হয়। কারণ তার ছিল প্রাকৃতিক সাজ, আজ অনেক কৃত্রিম সাজ তার অঙ্গে। আমাকে চিনতে তার এতটুকু স্মৃতিভ্রম হয়নি।

নতুবা কেন সে আমার দিকে ছুটে আসবে সংসারত্যাগী প্রেমিকার মতো?

আমাকে জড়িয়ে ধরে সে পৃথিবীর কান্নাকে এক করে ফেলে। এই কান্নার শব্দ নেই, অর্থ আছে।

আমাদের দিকে চেয়ে আছে সুপ্রিয়, চেয়ে আছে স্বরসতী-পুজামণ্ডপের ভক্তপ্রাণ। আমরা চেয়ে আছি আকাশের দিকে, অভিমানে যে আকাশ আজ অনেক দূরে!

Leave a Reply