You are here

বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ ও আপস্টেজ

বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’। বুদ্ধদেব জন্মগ্রহন করেন কুমিল্লায়। ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ জন্মগ্রহন করে ১৯৬৭ সালে। জন্মই যেন তার আজন্ম পাপ। তাইতো ১৯৬৯-৭৩ পর্যন্ত মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে মানে ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’কে।

কারন কী?
কারন সহজ। খুব সহজ।

অশ্লীলতার দায়ে ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’কে কাঠের ঘরে দাড়াতে হয়েছে। শেষে-মেষে অবশ্যই তাকে নিষ্পাপ ঘোষনা করা হয়। কিন্তু অশ্লীলতার দায় ত এমন এক দায় যা চূড়ান্ত হিসাবেও ডেবিট দেখানো যায় না। অর্থাৎ আমাদের সমাজে অশ্লীলতার অভিযোগ হয়তো মুছে যায় কিন্তু চিহ্ন থেকে যায় স্লোগানে স্লোগানে।

আপস্টেজ ( পহেলা মে, দুই হাজার ১৯) ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ নামে উপন্যাসটিকে মঞ্চায়ন করেছে। এই উপন্যাসটির প্রথম মঞ্চায়ন তারা করে ১৯ জুলাই, ২০১৯। সাধারন একটি সেট নির্মান করে মাত্র তিন জনের চারিত্রিক প্রবাহে মধ্যবিত্ত দাম্পত্য সংকলনযোগ্য-সংকট স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতার দিকে যাত্রা করেছে।

আলোর খেলা মার্জিত । ভালোর খেলা অনেকটা ক্লাস রুটিনের মতো ঠিক থাকে তবু যেন বেঠিক। নোটন বা মনিমালা জয়কে যেমনভাবে দর্শকের কাছে উপস্থাপন করে তেমন করে জয়কে আমরা পাই না। আমরা দেখতে পাই থিয়েটারে অংশু’র বলার স্টাইল আচরনের বাঙ্ময় আবর্তন খুব বেশি চারিত্রিক, খুব বেশি বলিষ্ঠ। সেট ডিজাইন কস্টিউম কালচার এখানে বলার মতো সাধারন কিন্তু অসাধারন। মঞ্চে মনিমালার মুভমেন্ট যথেষ্ট সজাগ। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আরও আপডেট করা যায়।

মনিমালার পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে আরও ভাবা যেতে পারে, ভাবা যেতে পারে পোশাক পরিকল্পনা নিয়ে। পোশাক পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন রুনা কাঞ্চন।

সেটে কোথাও জলের বোতল চোখে পড়েনি। অথচ জল জরুরী জীবনের জন্যে যেমন জরুরী ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রীর পূর্নতৃপ্ত আলাপ, বেচে থাকার বাসনা।

দরজার সামনে দুটি ফুলের টব হলে ভালো লাগতো। জয়কে মনিমালার সাথে চা খেতে দেখলে বিষয়টি কাব্যিক হয়ে ওঠতো। অবশ্যই জয় আর মনিমালা যথেষ্ট রোমান্টিক। অংশু কিন্তু রহস্যের এক জাল বিস্তার করে রাখে নিজের মাঝে। পরিষেবা পাওয়ার ইচ্ছাটা অংশুর মাঝে প্রবল। মঞ্চে অংশু’র এই প্রবল বাসনা উপেক্ষিত। এক ঘন্টার উপরে এই নাটক গ্রামীন নারীর মতো অল্প সাজে সজ্জিত তবে চরিত্রজল জোয়ারে সাগরমুখী।

অংশু মানে দীপ্তি। অংশু পড়াশোনা প্রিয় মানুষ। অংশু বিয়ে করে মনিমালাকে। প্রথমে তারা যৌথ পরিবারে বসবাস করতো। অংশু মনে করে যৌথ পরিবারে বসবাস করা মানসিক বিকাশের পথে অন্তরায়। তারপর তারা যৌথ পরিবার থেকে বের হয়ে ফ্লাটে উঠে। ফ্লাটে প্রায়ই চলে আড্ডা। আড্ডায় সময় দিতে এক প্রকার বাধ্য করে অংশু মনিমালাকে। মনিমালাও এক সময় আড্ডা প্রিয় হয়ে ওঠে। তার কথাও আড্ডার মানুষ মনোযোগে শুনে। এটি মনিমালার মনে বেশ অহমের জন্ম দেয়।

জয় অংশুর বন্ধু। জয় মনিমালারও বন্ধু হয়ে যায়। প্রথমে জয় মনিমালার মানসিক বন্ধু, তারপর শারীরিক, অনেকটা জাস্ট ফ্রেন্ড টাইপের।

মনিমালার মতে অংশু ভালোবাসা নামক যে ধারনা কেবল সেই ধারনারই ধারক। আর জয়? জয় সেই ভালোবাসার রাখাল। অর্থাৎ ভালোবাসতে গেলে যে যত্ন নেয়া লাগে সেই যত্নটা জয় নিতে পারে।

মনিমালা সময়কামী আর অংশু ব্যস্তকামী।

সময়কামী আর ব্যস্তকামীর মাঝখানে যে স্পেস নির্মিত হয় ঠিক সেই জায়গায় জয় প্রবেশ করে ফ্যামিলি ক্রাইসিস আইডলজির পতাকা নিয়ে। শুধু কী পতাকা? মনিমালার দেশে সেই পতাকা ও জয়বিধান প্রতিষ্ঠাও করে ফেলে।

বুদ্ধদেব বসু প্রথাগত যৌনতার প্রশ্নে একবার সময়ের আয়নায় সমাজকে এই উপন্যাসে মুখোমুখি করেছেন। কোনো সমাধানে দেননি তিনি। জয়ের প্রতি মনিমালার ফ্রয়েডিয় টান তিনি দেখালেন কিন্তু অংশুকে তিনি রাখলেন নিপাতনে শুদ্ধ সিন্ধু।

আপস্টেজের আয়োজনে সাইফ সুমনের নির্দেশনায় ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসকে কী নব নির্মান দিতে পেরেছ এমন প্রশ্ন করাই যায়। এমন প্রশ্ন করার আগে এটাও জানার বিষয় বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ উপন্যাসটির নব নির্মানের দায়িত্ব কি তারা নিতে পারবে?

অতীত আর বর্তমানকে সামনে রেখে প্রতিভাবানরা প্রাজ্ঞরা নির্মান করেন ভবিষ্যৎ। এই নির্মিত ভবিষ্যৎ সর্বদা নিশ্চিত নয়। অনিশ্চিত পাঠাতনে নিশ্চিত কথাটি বলা কঠিন। স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু বলতে পারেননি মনিমালার জয় কেন তার জীবনে সংকট যেখানে অংশু একজন স্বামী নামক স্ট্যাচু।

যৌনজীবন আর যৌনতা এক কথা নয়। মানু‌ষের জন্যে প্রানীদের জন্য যৌনজীবন আবশ্যক হোক পাহাড়ে কিংবা সমতলে। যৌনতা ল্যাবরেটরির বিষয়।

মনিমালার যৌনজীবনে জয় কৃষ্যমান, অংশু মনিমালাকে আকর্ষন করতে পারছে না। অথবা অংশু যৌনজীবনে যেমন পারদর্শিতা প্রদর্শন করার দরকার তা করতে পারছে না। যৌনতা নিয়ে অনেক কথা বলা যায় কিন্তু যৌনজীবন বেসিক সারভাইভালের জন্য সহজভাবে গ্রহনযোগ্যতা পাওয়ার দাবি রাখে। বিয়ে নামক দালিলিক কথাবার্তা এনে যৌনজীবনে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা বেসিক সারভাইভালের বিপক্ষে সাংগঠনিক তৎপরতা মাত্র। আর এহেন হীন তৎপরতা সমাজের প্রতিদিনের মৃত্যুর জন্য দায়ী। টুকরো টুকরো মৃত্যু। চোখে পড়ছে না কিন্তু প্রশান্তির গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এই মৃত্যু আর জীবনের চালে বুদ্ধদেব বসু না বলেছেন স্পষ্ট কথাটি তার ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ উপন্যাসে, না দেখিয়েছেন আপস্টেজ তার মঞ্চের আলো আধারের নির্জন সরব চারিত্রিক প্রবাহে।

আমাদেরকে প্রতিনিয়ত সংশয় নিয়ে বেড়ে উঠতে হবে। এটাই নাকি তৃতীয় মানসিকতার সংকট। কেউ কেউ বলবেন মধ্যবিত্ত জীবনের প্রয়াস। হায়রে মধ্যবিত্ত! রাতের আড়ালে তারা সেক্স করতে পারে কিন্তু দিনের আলোতে সেক্স এক ট্যাবুর নাম তাদের কাছে। আপস্টেজ এই ট্যাবুতে খোচা দিয়েছে মাত্র। তাতে কিচ্ছু হবে না। খোচা-টোচা মেডিসিন দিয়ে ক্যান্সারের মতো মহামারীর সমাধান দেয়া যায় না, যায় না।

Leave a Reply

Top