You are here
Home > গল্প >

কবুতর

শ্যামবাঢী। শান্তিনিকেতন। রুম ভাড়া নিয়ে থাকি। সকালে বৌদির দোকানে যাই, চুপ করে লুচি- ঘুগনি তারপর দুই কাপ চা খেয়ে সোজা রুমে চলে আসি। গাছের নিচে টিনের চাল, চালের নিচে একমাত্র আমি।

দুপুরে রুমে রান্না করি– ভাত, আলু অথবা ডিম। কোনোদিন আলু-ডিম একসাথে। ঢেড়সভাজি মাঝে মাঝে তরকারির তালিকায় অভিজাত হিশেবে জায়গা করে নেয়। খুব বেশি অলস হয়ে উঠলে রান্না করা গরম ভাতের সাথে আগুনছ্যাঁকা শুটকীই যথেষ্ট।

দুপুরে জয়দেব দার কাছ থেকে কয়েক গ্লাস আখের রস খাওয়ার জন্য বের হই। দুপুরেই সূর্যের সাথে আমার দেখা হয়, কেবল দুপুরেই। কতটুকু সূক্ষ্ম হলে নিজেকে দেখা যায় জানি না তবে জানার ব্যাকুল তিয়াস নিয়ে নিমজ্জিত থাকি সময়ের বিন্দু বিন্দু রেখায়।

পৃথিবীতে যখন অন্ধকার নামতে শুরু করে, সব পাখি যখন নীড়ে ফিরে, সবাই যখন অন্ধকারকে ঘরে ফেরার আযান মনে করে আমি তখন রুম থেকে বের হই। সুবর্ণ রেখায় যাই, বই দেখি, বই কিনি। সমবায় থেকে ড্রাই ফুড, পেস্ট, আদা, মরিচ প্রভৃতি সংগ্রহ করি।

সন্ধ্যালগ্নে আমার প্রধান কাজ একটিই — হাঁটা। বিনয় ভবন যাওয়ার রাস্তাটি ধরে হাঁটতে থাকি। নির্জন, নির্জন এবং নির্জন। মাঝে মাঝে দুই একটি সাইকেলের শব্দ। সাইকেলের পেছনে নারীপাখির কলরব, নারীনদীর কলতান। কলরবে, কলতানে আমার হায় চিলের কথা মনে পড়ে–কে হায় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।

হাঁটতে হাঁটতে সৃজনী শিল্পগ্রাম পর্যন্ত যাই। তখন পৃথিবীর জন্য সৃজনী শিল্পগ্রামের দরজা বন্ধ। দূর থেকে চেয়ে থাকি অপলক। রঞ্জিত ক্ষ্যাপার গান স্মৃতির বাতাসে ভাসতে থাকে —

পুরুষ অ যইবনঅ কালে হাতে মোহন বাঁশি
নারীর অ যইবনঅ কালে রে মুখে মৃদু হাসি

সৃজনী শিল্পগ্রামের দেয়াল অদৃশ্য হয়ে যায়, আমি তখন পুকুর পাড়ের পূর্ব দিকের ঘাটসিঁড়িতে বসি, এক জোড়া অগোছালো চোখ, কাফনে মোড়ানো হৃদয়কাপানো এক এবং একক সুর আমার দিকে তেড়ে আসে — আমাকে জীবিত করে, আমাকে বিরহী করে, আমাকে মরে যেতে সহায়তা করে।

আজ থেকে দেড় বছর আগে ….

অরশ্রী মার্কেট থেকে রুমে ফিরছি। নিমবৃষ্টি শান্তিনিকেতনের আকাশে। বৃষ্টিকে মাথায় নিয়ে হাঁটছি। আম্রকুঞ্জ চুপচাপ। নীরব আম্রকুঞ্জে কিছুক্ষণ ধ্যানমগ্ন থেকে থোকা থোকা নির্জনতা আমার দেহের ভাঁজে ভাঁজে ইনস্টল করছি।

কখন ঝড় এলো, কখন শিলাবৃষ্টিতে আহত হলো আম্রকুঞ্জ বুঝতেই পারিনি। নিজের জলভেজা শরীরখানা দেখে বিস্মিত, বিস্মিত হতে হলো একটি বিধ্বস্ত কবুতর দেখেও। উড়তে চায়, উড়তে পারে না।

কবুতরটি হাতে নিলাম….

কবুতরটির শরীরে স্বজন হারানোর গন্ধ লেগে আছে, লেপ্টে আছে ঝড়ের তাণ্ডব লীলা। এক সময় হয়তো তার পরিবার ছিল, প্রেমিক ছিল, আজ সে আমারই মতো একা। মন থেকে তাকে আপন করে নিলাম, হৃদয়ের গোপন এলাকায় আসন পেতে দিলাম।

রুমে নিয়ে গেলাম। আমার সন্ধ্যা বেলার হাঁটার সঙ্গী করলাম। মানসিকভাবে নগ্ন হয়ে তাকে প্রেম শেখালাম, বাঁচতে শেখালাম। সে খেতে পারে না, হাত দিয়ে, ঠোঁট দিয়ে দিনের পর দিন তাকে খাওয়ালাম।
একদিন কবুতরটি সম্পূর্ণ সুস্থ হবে, আকাশে উড়বে এমনই স্বপ্ন ছিল আমার।
অথচ
কোনো এক সকালে কবুতরটি আকাশে উড়াল দিল। আনন্দের কথা। কিন্তু আমি আনন্দিত হতে পারিনি। কারণ কবুতরটি এখনো সুস্থ হয়নি, এখনো সে মাথা সোজা করে দাঁড়াতে শিখেনি, এখনো তার পায়ে ভবের দড়ি।

হায়রে আমি কবুতরটিকে সুস্থ করতে পারিনি!

আহারে কবুতরটি হয়তো কোনো শিকারির হাতে পৌঁছে যাবে!

দুঃখ আমার কবুতরটি স্বজন চিনতে পারেনি!

আমি কিন্তু এখনো কবুতরটিকে খুঁজি বিনয় ভবনে,
প্রান্তিক রেলওয়ে স্টশনে,
পূর্বপল্লী গেস্ট হাউজের দুইশত চব্বিশ নাম্বার রুমে, গীতাঞ্জলি সিনেমা হলে,সৃজনী শিল্পগ্রামে,
সাইন্সসিটি কিংবা শ্রীরামপুরের অর্ধসংবৃত সন্ধ্যায় গঙ্গা মায়ের উদার ঘাটে,
আমি এখনো খুঁজি।

Leave a Reply

Top